উপহার

৮ই মে – আমার জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ দিন । দিনটি আমার সবচেয়ে প্রিয়বন্ধু দীনেশের জন্মদিন । কিন্তু দুই বছর আগের ঘটনার জন্য দিনটা আমার কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে । ওই ঘটনার সাথে আমি আকস্মিকভাবে জড়িত থাকলেও ঘটনার প্রেক্ষাপট দীনেশ ও তার মায়ের কাছ থেকে পরে জেনেছিলাম । সেই ঘটনাগুলিকে যথাসম্ভব গুছিয়ে বলার চেষ্টা করছি ।

দীনেশ আমার খুব ছোটবেলার বন্ধু । আমরা হায়ার সেকেন্ডারি পর্যন্ত একসাথে পড়েছি । তারপর কলেজ আলাদা হয়ে গেলেও আমাদের বন্ধুত্বে কোন ভাঁটা পড়ে নি । দীনেশ থাকতো তার মায়ের সাথে এক দু-কামরার ভাড়াবাড়িতে । ওর বাবা ওর পাঁচ বছর বয়সে ক্যান্সারে মারা যান । বাবা খুচরো ব্যবসায়ী ছিলেন । উনি থাকাকালীন ওদের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল । কিন্তু মারণ ব্যাধি সেই সচ্ছল অবস্থা কেড়ে নেয় । কাকিমা মানে দীনেশের মা একটা কাপড়ের কারখানায় টেলারিং-এর কাজ করে দীনেশকে বড় করেছেন । স্বামীর চিকিৎসা ও জীবনের এতটা পথ অতিক্রম করতে প্রায় সমস্ত গহনা বিক্রি করতে হলেও তিনি বাঁচিয়ে রেখেছিলেন তাদের পরিবারের একটা পারম্পরিক সোনার হারকে । এই হারটি তিনি বিয়ের সময় দীনেশের ঠাকুমার কাছ থেকে পেয়েছিলেন । যদিও সেই সময় হারটির সাথে ম্যাচিং কানের দুল ছিল । কিন্তু দুর্ভাগ্য বশত সেই দুল জোড়া একটি বিয়ে বাড়িতে হারিয়ে যায় । অনেক বাধা বিপত্তি স্বত্বেও কাকিমা এই হারটি গুছিয়ে রাখেন দীনেশের ভাবী বধূর জন্য ।

দীনেশ পড়াশুনায় খুব সাধারণ ছিল । কিন্তু ফটোগ্রাফির হাত ছিল দুর্দান্ত । দীনেশের ফটোগ্রাফি শেখার পিছনে যদিও আমার হাত অনেকটাই । আমার ১৮ বছরের জন্মদিনে আমার মামা একটা Digital SLR ক্যামেরা উপহার দেন । সাধারণ ক্যামেরাতে আগে ছবি তুললেও SLR ক্যামেরা আমার কাছে নতুন ছিল । তাই আমি মামাকে অনুরোধ করি ওই ক্যামেরাতে ছবি তোলা ও এডিটিং শেখানোর জন্য । দীনেশও শেখার ইচ্ছে প্রকাশ করে । মামা কয়েকটা ক্লাস নিয়ে আমাদের সবকিছু শিখিয়ে দেন । তারপর আমরা দুজনে ঐ ক্যামেরা নিয়ে বিভিন্ন ছবি তুলে হাত পাকা করি । হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর আমরা বেশ কয়েকটা জায়গা ঘুরতে যাই বন্ধুদের সঙ্গে । সেখানেও তোলা হয় অসংখ্য ছবি । মামা সেই ছবি দেখে দীনেশকে প্রশংসা করে বলেন যে ওর ছবি তোলার হাত ভীষণ ভালো – অনেকটা প্রফেশনাল ফটোগ্রাফারদের মতো । ও যেন ফটোগ্রাফির শখ ছেড়ে না দেয় । মামা তার পরিচিত এক বন্ধুর সূত্রে একটা ফটো স্টুডিওতে ওর একটা পার্ট-টাইম চাকরির বন্দোবস্ত করে দেন । ওর নিজের ক্যামেরা না থাকার জন্য ও সেখানে শুধু এডিটিঙের কাজ শুরু করে ।

২০১০ সালের শেষের দিকে একটা অ্যামেচার ছবি প্রতিযোগিতা হয় । সেখানে আমার জোরাজুরিতে দীনেশ আমার ক্যামেরায় তোলা এক সাঁওতাল রমণীর ছবি পাঠায় এবং সৌভাগ্যবশত সে প্রথম পুরস্কার স্বরূপ একটা Canon এর DSLR ক্যামেরা পায় – সাথে একটি বেসিক লেন্স । পুরস্কার পেয়ে দীনেশ ও কাকীমার খুশির সীমা থাকে না । দীনেশও উদ্যম পায় । কয়েকমাসের মধ্যে সে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড কম্পিউটার সস্তায় কিনে নেয় বাড়ীতে এডিটিং করার জন্য । নতুন ক্যামেরা পাবার পর থেকে সে তার স্টুডিওর প্রধান ফটোগ্রাফারের সাথে বিয়ে বাড়ীতে ছবি তুলতে যাওয়া শুরু করে । কিছুদিনের মধ্যে সে বুঝতে পারে তার কাছে থাকা লেন্সটি যথেষ্ট নয় । আরো কিছু স্পেশালাইজড্ লেন্স প্রয়োজন । একদিন আমি ওর বাড়ীতে গিয়ে বেশ জোরাজুরি করি লেন্স কেনার ব্যাপারে । কাকীমা শুনতে পেয়ে দাম জিজ্ঞেস করেন । দাম শুনে উনি বিমর্ষ হয়ে পড়েন । দীনেশ আমাকে বোঝায় অনেক কষ্টে ওদের সংসার চলছে । এই অবস্থায় অত টাকা খরচ করাটা বিলাসিতা ।

২০১১ সালের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি আমি খবর পাই একটা ফটোগ্রাফি ওয়ার্কশপ হবে মে মাসের শেষের দিকে । দেশ বিদেশের নামী ফটোগ্রাফাররা সেই ওয়ার্কশপ নেবেন । আমি জানামাত্রই দীনেশকে অংশগ্রহণ করতে বলি । রেজিস্ট্রেশন ফী শুনে দীনেশ বেশ দমে যায় । ও বলে ওর কাছে থাকা সাধারণ লেন্স নিয়ে ওখানে যাবার কোন মানে হয় না । ওখানে ভালো করে শিখতে হলে আরো ভালো লেন্সের প্রয়োজন । আমি বোঝাই যে একটা পোট্রেট  লেন্স থাকলেই কাজ চলে যাবে । আমি আশ্বাস দিই কারুর কাছ থেকে ঐ কদিনের জন্য ঐরকম লেন্স যোগাড় করে দেবার । তবুও দীনেশ প্রস্তাবে রাজী হয় না । শেষে আমি বলি যে ওর ভবিষ্যতের জন্য এটা দরকার । এর মাধ্যমে ও অনেক ভালো ফটোগ্রাফার হতে পারবে – আর্থিক সচ্ছলতা আসবে । গতানুগতিক কোন সাধারণ চাকরীর থেকে ওর ফটোগ্রাফিতে উন্নতি করার সম্ভাবনা অনেক বেশি । কাকীমা আমাদের কথোপকথন শুনছিলেন । দীনেশকে বোঝাতে বলতে উনি মাথা নিচু করে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন । পরে জেনেছিলাম আমার কথাগুলো কাকীমার চিন্তাভাবনাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল ।

এর সমসাময়িক আরো একটা ঘটনা ঘটে । দীনেশের মাসতুতো দিদির বিয়ে ঠিক হয় জুন মাসের শুরুতে । সেই সূত্রে এপ্রিল মাসের শেষে কনের গয়না পছন্দ করার জন্য দীনেশের মাসি ও দিদির সাথে কাকীমা যান গয়নার দোকানে । দীনেশের সেদিন কোন কাজ না থাকায় ও ওদের সাথে যায় । গয়না দেখতে গিয়ে সবার নজর পড়ে একজোড়া সুন্দর সোনার কানের দুলের উপর । দুল জোড়া কাকীমার অবশিষ্ট পারিবারিক সোনার হারটির হুবহু ম্যাচিং । দোকানদার দাম জানায় প্রায় কুড়ি হাজার টাকা । দীনেশের মাসি কাকীমাকে দুল জোড়া কিনতে বলেন । উনি যুক্তি দেখান হারটি মানানসই দুল জোড়া ছাড়া অপূর্ণ । দীনেশের বিয়েতে দুল ছাড়া শুধু হার দেওয়া বড়ই অসম্মানজনক দেখায় । যুক্তিটা কাকীমার মনে গভীর দাগ কাটে । তার ফল আমি কয়েকদিনের মধ্যে জানতে পারি ।

সেদিন ছিল শনিবার ৭ই মে । কাকীমা দীনেশের অজান্তে আমাকে দেখা করতে বলেন । কাকীমার অনুরোধে একটা ভালো ক্যামেরার দোকানে ওনাকে আমি নিয়ে যাই । উনি আমাকে দীনেশের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় লেন্সটা পছন্দ করতে বলেন । আমি উদ্দেশ্য ও গোপনীয়তা দুইয়ের কারণ বুঝতে পারি । লেন্স পছন্দ করে কেনার সময় কাকীমার পার্সে একগোছা ১০০০ টাকার নোট দেখে অবাক হয়ে যাই । পরে জেনেছিলাম ছেলের ফটোগ্রাফিতে ভালো কেরিয়ারের কথা ভেবে উনি উনার আঁকড়ে থাকা শেষ সম্বল পারিবারিক হারটা বিক্রি করেন – যাতে লেন্স কেনা হয় ও দীনেশ ওয়ার্কশপে অংশ নিয়ে পারে ।

পরদিন ৮ই মে রবিবার, দীনেশের ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয় । দাঁত মেজে খবরের কাগজটা পড়ার সময় দেখে কাকীমা স্নান করে একটা পিতলের থালা নিয়ে তার সামনে হাজির । থালায় চন্দন বাটা এবং এক বাটি পায়েস । কাকীমা কপালে চন্দনের ফোঁটা ও এক চামচ পায়েস খাইয়ে জন্মদিনের অভিনন্দন জানান । তারপর পাশের ঘর থেকে রঙিন কাগজে মোড়া উপহার দেন । উপহারটি না খুলেই দীনেশ তার দেরাজ থেকে একটা লাল রঙের বাক্স কাকীমার হাতে দিয়ে বলে – “Happy Mother’s day! মা ।”

খুশি হয়ে বাক্সটা খুলে দেখেন গয়নার দোকানে দেখা সেই কানের দুল জোড়া । কাকীমা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করেন – “এটা কিনলি কী করে? এত টাকা কোথা থেকে পেলি ?”
দীনেশ তার জন্মদিনের উপহারটি হাতে নিয়ে বলে – “চিন্তা করো না মা । চুরি করি নি । ক্যামেরাটা বিক্রি করে দিয়েছি ।”

গল্পটির প্রথম প্রকাশ অনলাইন ম্যাগাজিন hatpakha তে। http://www.hatpakha.com/upohaar/

লেখকের মন্তব্য: গল্পটি বিখ্যাত ছোটগল্প The Gift Of The Magi থেকে অনুপ্রাণিত।

3 thoughts on “উপহার

Leave a reply to sumanta dey Cancel reply