– এক –
সুমিত ও কার্তিক স্কুল থেকে বাড়ী ফিরছে। আজ ওদের স্কুল হয় নি। একজন বয়স্ক মাস্টারমশাই কাল রাতে মারা গেছেন। তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে প্রেয়ারের পর ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। তাড়াতাড়ি ছুটি হলেও ওরা একটু খেলাধুলা করে নিয়েছে বাকী বন্ধুদের সাথে। মধ্যাহ্নের সূর্য প্রখর হবার সঙ্গে ওরা খেলা গুটিয়ে এখন বাড়ীর অভিমুখে রওনা হয়েছে।
ওরা দুজনেই কসবার কাছে এক বস্তিতে থাকে। সুমিত থাকে তার মায়ের সাথে। ওর বাবা মারা গেছেন তিন বছর আগে। ওর মা বিভিন্ন বাড়ীতে বাসন-মাজা, ঘর ঝাঁট-মোছার কাজ করে সংসার চালান। কার্তিকের অবস্থা সামান্য ভাল। ওর বাবা নিউজপেপার, ম্যাগাজিন বিক্রি করে সংসার চালান। এই দুই দশ বছরের খুদে সদস্যরও সংসারে কিছু অবদান আছে। ভোরবেলা উঠে ওরা বস্তির আরও কয়েকজন বাচ্চার সাথে কাগজ কুড়ুনির কাজ করে। প্লাস্টিক, পলিথিন ব্যাগ, আস্ত শিশি-বোতল ইত্যাদি সংগ্রহ করে বাড়ী নিয়ে আসে। সেগুলো ওদের বাবা-মা বিক্রি করে দেন। এই সামান্য কটা টাকায় কিছুই হয় না। তবু ওদের কাছে এটা অনেকটাই খেলার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। পড়াশুনার তেমন ক্ষতি হয় না বলে ওদের বাবা মা এতে আপত্তি করে না।
প্রতিদিনের মতো আজও ওরা নতুন এপার্টমেন্টটার পাশের মাঠটা দিয়ে শর্টকাট ধরল। দুজনে আজকের খেলার গল্প নিয়ে মশগুল। হঠাৎই কার্তিকের নজরে পড়ল রাস্তার ধারে একটি বিদেশী সিগারেটের খালি বাক্স। সে সেটাকে তুলে ভিতরের রাংতা কাগজটার ঘ্রাণ নিল। এই গন্ধ তার ভীষণ ভাল লাগে। বিদেশী সিগারেট বলে গন্ধটা একটু হালকা। সুমিত আগে যাচ্ছিল, তাই সে কার্তিকের পিছিয়ে পড়া খেয়াল করে নি। একটু এগোতেই সে দেখতে পেল এপার্টমেন্টের দেওয়ালের পাশে একটা ঝোপের মধ্যে কী যেন একটা পড়ে আছে। কাছে যেতেই সে বুঝতে পারল সেগুলি একটি মোবাইল ফোনের বিভিন্ন অংশ। হ্যান্ডসেট, ব্যাটারি, ব্যাক-কভার আলাদা হয়ে পাশাপাশি পড়ে আছে।
সে কুড়িয়ে নিয়ে কার্তিককে ডাকল –“কার্তিক, দেখ কী পেয়েছি!”
কার্তিক দৌড়ে তার কাছে এসে দেখে বলল – “আরিব্বাস, এতো মোবাইল ফোন।“
মোবাইলের সামনের দিকটা দেখে সে বলল –“বেশ বড় স্ক্রিন তো, দামী হবে মনে হয়।“
সুমিত জিজ্ঞেস করল –“এটা বিক্রি করলে অনেক দাম পাব?”
কার্তিক – “ঠিকঠাক চললে অনেক দাম দেবে। সেদিন বুকাইদা একটা মোবাইল ফোন পেয়েছিল। বলল বিক্রি করে এক হাজার টাকা পেয়েছে।“
সুমিত – “এক হাজার টাকা পাব?”
কার্তিক – “আগে ঠিক আছে কিনা দেখতে হবে তো।“
এবার কার্তিক মোবাইলের পিছন থেকে সিমকার্ডটা বার করে ফেলে দিল।
সুমিত অবাক হয়ে বলল – “ওটা ফেলে দিলি কেন?”
কার্তিক – “সেদিন বুকাইদাও ওটা বার করে ফেলে দিল। আমি জিজ্ঞেস করতে বলল ওটা কোন কাজের নয়। মোবাইল পেলেই ওটা আগে ফেলে দিবি। ওটা না ফেললে ঝামেলা হতে পারে।“
সুমিত – “কী ঝামেলা হবে?”
কার্তিক – “তা জানি না। বুকাইদা বলেছিল তাই করলাম।“
দুজনে এগিয়ে চলল। কার্তিক ব্যাটারি পরিয়ে মোবাইলটা অন করল। ডিসপ্লেতে ছবি ও লেখা ফুটে উঠল।
কার্তিক – “ফোনটা ঠিক আছে রে। তোর লাকটা খুব ভাল। পুজোর আগে একটা দামী জিনিষ পেলি। সেদিন বুকাইদাও একটা মোবাইল পেল। আমিই কিছু পাই না।“
খুশি মনে সুমিত ও বিষণ্ণ মনে কার্তিক বাড়ী ফিরল। সুমিত ঘরে ঢুকে দেখল তার মা রান্না করছে। ওর মা জিজ্ঞেস করলেন – “কীরে, এত তাড়াতাড়ি চলে এলি। স্কুলে যাস নি?”
সুমিত স্কুল ব্যাগটা বিছানার উপর খুলে রেখে বলল – “একজন স্যর মারা গেছেন বলে স্কুল ছুটি দিয়েছে।“
সুমিতের মা – “তাহলে এতক্ষণ কোথায় ছিলি?”
সুমিত – “আজ সেকেন্ড হাফে খেলা ছিল তো। গণেশ ফুটবলটা এনেছিল। তাই ফুটবল খেলছিলাম।“
সুমিতের মা – “ও আচ্ছা। ইউনিফর্ম ছেড়ে হাত পা ধুয়ে নে।“
সুমিত ইউনিফর্ম না খুলেই তার মাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল।
সুমিতের মা খুশি হয়ে বললেন – “কীরে, কী হয়েছে? খুব খুশি মনে হচ্ছে!”
সুমিত গদগদ কণ্ঠে বলল – “জান মা, আজ একটা জিনিষ রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছি।“
সুমিতের মা – “কী জিনিষ?”
সুমিত তার পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বার করে মাকে দেখাল।
সুমিতের মা বিস্মিত হয়ে বললেন – “সত্যি কুড়িয়ে পেয়েছিস? চুরি করিস নি তো?”
সুমিত – “সত্যি বলছি, কুড়িয়ে পেয়েছি। তুমি কার্তিককে জিজ্ঞেস কর, ও সাথে ছিল তো।“
সুমিতের মা – “আচ্ছা, সাবধানে রেখে দে।“
সুমিত ফোনটা পকেটে রেখে দিয়ে আবার তার মাকে জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বলল – “মা।”
সুমিতের মা – “কী বল।“
সুমিত – “কার্তিক বলছিল বুকাইদা কয়েকদিন আগে ঐ রকম একটা ফোন বিক্রি করে এক হাজার টাকা পেয়েছে।“
সুমিতের মা কড়াইতে খুন্তি নাড়তে নাড়তে বললেন – “তাই! তাহলে তো এটা বিক্রি করে অনেক টাকা পাওয়া যাবে।“
সুমিত – “মা।“
সুমিতের মা – “বল, আর কী বলবি।“
সুমিত – “বলছি, সেদিন দোকানে যেটা দেখেছিলাম, সেটার দাম কত ছিল?”
সুমিতের মা – “কোনটা? … ও আচ্ছা! তাই বলি ছেলে হঠাৎ এত আদর করছে কেন। মোবাইলটা বিক্রি করলে ওটার দাম হয়ে যাবে। তাহলে তোকে পুজোয় ওটা কিনে দেব। ঠিক আছে?”
সুমিত ভীষণ খুশি হয়ে মায়ের গালে একটা চুমু খেয়ে জামা কাপড় ছাড়তে চলে গেল।
– দুই –
দুপুর দেড়টা। তিন বছরের মেয়েকে খাইয়ে মিনতি খেতে বসেছে। আজ বড্ড খাটনি গেছে তার। কাল রাত থেকে মেয়ে ভীষণ কাশছে। শরীরটাও গরম ছিল সকাল থেকে। তাই মেয়েকে প্রি-স্কুলে পাঠায় নি। মেয়েকে সামলে রান্না, ওয়াশিং মেশিনের কাপড় মেলা, বিছানার বেড কভার চেঞ্জ, ডাস্টিং করে একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে। ব্রেকফাস্টের পর কিছু না খাওয়ায় খিদেটাও জমপেশ পেয়েছে। অনেকটা ভাত, শাক, মাছের মুড়ো দিয়ে ডাল, সরষে-ইলিশ ও আমড়ার চাটনি নিয়ে আয়েশ করে খেতে বসেছে সে। মেয়ে পোগো চ্যানেলে ছোটা ভীম দেখতে ব্যস্ত, ফলে শান্তিপূর্ণভাবে সে খেতে পারবে।
কলিং বেলের আওয়াজ তার খাওয়ায় বিঘ্ন ঘটাল। কাজের মেয়েটার আসতে দেরী আছে। তাহলে অন্য কেউ এসেছে। খাবারটা একটা থালা ঢাকা দিয়ে, হাত মুখ ধুয়ে সে ফ্লাটের দরজাটা খুলল। পাশের ফ্লাটের বানী অসময়ে এসে পড়েছে।
বানী – “অ্যাই, তুমি খাচ্ছিলে? তোমাকে অসময়ে ডিস্টার্ব করলাম।“
মিনতি – “আরে, সেইরকম কিছু না। ভিতরে এস।“
বানী – “না গো, ভিতরে আসব না। তোমাকে একটা দরকারি কথা বলতে এলাম। তোমার কর্তা ফোন করেছিল। বলল তোমাকে ফোনে পাচ্ছে না, তাই খবর দিতে। একটা ফোন করে নিও।“
মিনতি – “ও ফোন করেছিল। কই আমি তো শুনতে পাই নি। মেয়ে হয়ত মোবাইলটা ঘরে নিয়ে রেখেছে। ইস, তোমার বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটল। ভীষণ খারাপ লাগছে। সরি।“
বানী – “ধ্যুর, তুমি এতো ফর্মালিটি কোরো না তো। বিশ্রামের সময় যেন চলে যাচ্ছে। তুমি খেয়ে নাও, তারপরে ফোন করো। সজলদা কিন্তু বলেছে আর্জেন্ট কিছু নয়। আচ্ছা এখন চলি। কিছু দরকার হলে বোলো।“
মিনতি দরজা বন্ধ করে চোখ বুলিয়ে মোবাইলটা খোঁজার চেষ্টা করল। দুটি ঘরের বিছানা বা সাইড টেবিলেও নেই, ড্রেসিং টেবিলেও নেই। কোথায় গেল ফোনটা?
সে ভেবে বার করল মাকে ফোন করার পর সে ডাইনিং টেবিলটার উপর মোবাইলটা রেখেছিল। তাহলে নিশ্চয়ই মেয়ে নিয়েছে। ও কোথায় রেখেছে কে জানে। এদিকে পেটে আগুন জ্বলছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সে খাবারগুলো গলাধঃকরণ করল। এরপর চলল আবার মোবাইল খোঁজা। মেয়ের খেলনার বাক্স, সাইকেলের পিছনের বাক্স, সোফার পিছন – কোথাও পাওয়া গেল না মোবাইলটা। কেউ ফোন করলে রিংটোনের আওয়াজ থেকে কোথায় আছে সহজে বোঝা যাবে। কিন্তু বাড়ীতে তো আর কোন ফোন নেই।
উপায় না দেখে বানীকেই ডেকে আনল সে। বানী তার ফোন থেকে কল করে দেখল মোবাইল সুইচ-অফ বলছে। ফোনটার সন্ধান পাওয়া আরও কষ্টকর হয়ে উঠল। বানীকে আবার বিব্রত করার জন্য সরি বলে সে আরও কিছু জায়গা খোঁজার বৃথা চেষ্টা করল। মেয়েকে জিজ্ঞেস করতে হবে, তবে সঠিক উত্তর পাওয়া যাবে কিনা তার ঠিক নেই।
মিনতি – “মাম্মা, মার ফোনটা টেবিলে ছিল, তুমি কোথায় রেখেছ?”
মিনতির মেয়ে – “ফোন … সেই যে ছোটা ভীম থো করে দিল, আমিও থো করে দিয়েছি।“
মিনতি – “কোথায় থ্রো করে দিয়েছ?”
মেয়ে আঙুল দিয়ে ব্যালকনির দিকে নির্দেশ করল। সর্বনাশ! মেয়ে তাহলে মোবাইলটা তিনতলা থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। কোথায় পড়েছে কে জানে। এপার্টমেন্টের বাউন্ডারির ভিতরে পড়তে পারে, না হলে পাশের মাঠটাতে। মেয়েকে একা রেখে কী করে সে খুঁজতে যাবে?
উত্তর খুঁজতে খুঁজতে কলিং বেল বেজে উঠল। দরজা খুলে কাজের মেয়েটাকে দেখে সে প্রশ্নের সমাধান পেল।
মিনতি –“লক্ষ্মী, একটা কাজ প্লিজ আগে করে দে। মেয়ে আমার মোবাইলটা ব্যালকনি থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। তুই একটু নীচে গিয়ে দেখ না যদি পাস। খুব অসুবিধায় পড়েছি।“
লক্ষ্মী –“আচ্ছা বৌদি, খুঁজে আসছি।“
মিনতি – “সিকিউরিটিকেও একবার জিজ্ঞেস করিস যদি পেয়ে থাকে।“
“আচ্ছা।” – বলে লক্ষ্মী নীচে চলে গেল। মিনতি ব্যালকনি থেকে নীচে দেখার চেষ্টা করল। লক্ষ্মী এপার্টমেন্টের ভিতরে কিছু খুঁজে পেল না। সিকিউরিটিও মোবাইল সম্বন্ধে কিছু বলতে পারল না।
লক্ষ্মী নীচ থেকে চেঁচিয়ে বলল – “বৌদি, এখানে তো পড়ে নেই।“
মিনতি – “তাহলে আরেকটু কষ্ট করে পাশের মাঠটাতে একটু দেখ।“
লক্ষ্মী পাশের মাঠে খুঁজতে গেল। বাচ্চা মেয়ে খুব জোরে ছুঁড়তে পারবে না। ব্যালকনির নীচে কাছাকাছিই পড়বে। লক্ষ্মী ব্যালকনি লক্ষ্য করে খোঁজা শুরু করল। কোথাও মোবাইলের হদিশ মিলল না। ব্যালকনির নীচের ঝোপটাতে একটা সিমকার্ড পড়ে থাকতে দেখল সে।
লক্ষ্মী – “বৌদি, কাছাকাছি তো কোথাও পেলাম না। তবে একটা সিমকার্ড পড়ে আছে।“
মিনতি – “পেলি না! আচ্ছা, তুই সিমকার্ডটা নিয়ে উপরে চলে আয়।“
সিমকার্ডটা কি তার? কেউ কি সিমকার্ড ফেলে মোবাইল নিয়ে চলে গেছে? অন্য কারুরও হতে পারে সেটা। চেক করে দেখতে হবে। উত্তরের জন্য আবার বানীর দ্বারস্থ হতে হল তাকে। বানী নিজের হ্যান্ডসেটে সিমকার্ডটা ঢুকিয়ে সিমকার্ডে থাকা নাম্বারগুলো মিনতিকে দেখাল। মিনতি বুঝতে পারল এটা তারই ফোনের সিমকার্ড। বানীর কাছে পারমিশন নিয়ে সে সজলকে ফোন করল।
সজল – “কী গো, ফোনটা কোথায় ছিল? মেয়ে কেমন আছে জানার জন্য কতবার ফোন করছি, একবারও তুললে না। ফোনের মিসড কলটাও তো মাঝে মাঝে চেক করে দেখতে পার।“
মিনতি – “মেয়ে ভাল আছে। জ্বর আসে নি। শুনছ, তুমি প্লিজ রাগ করো না। মোবাইলটা হারিয়ে গেছে।“
সজল – “হারিয়ে গেছে মানে? তোমার নাম্বার থেকেই তো ফোন করছ।“
মিনতি – “আসলে আমি বানীর মোবাইল থেকে ফোন করছি। মেয়ে ব্যালকনি থেকে ফোনটা ফেলে দিয়েছে। নীচে শুধু সিমটা খুঁজে পাওয়া গেছে। আমি সিমটা বানীর সেটে লাগিয়ে ফোন করছি।“
সজল – “মেয়ে ফেলে দিল তুমি লক্ষ্য করলে না? কী করছিলে তখন?”
মিনতি – “তুমি বাড়ী ফিরে এসে এই নিয়ে কথা বোলো। বানীকে ফোনটা ফেরত দিতে হবে।“
দুপুরে আর ঘুম হল না মিনতির। সজল স্বাভাবিকভাবেই রেগে গেছে। দুমাস আগে মোবাইলটা কেনা। সজল ফিরে এসে কী যে বকা দেবে সেটা ভেবে মন খারাপ হয়ে গেল তার।
সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় সজল বাড়ী ফিরল। দরজা বন্ধ করে কাঁধের ল্যাপটপ ব্যাগটা সোফায় রেখে মিনতির উদ্দেশ্যে রেগে বলল – “সারাদিন কী কর? একটা মেয়েকে সামলাতে পার না। মোবাইলটা বাইরে ফেলে দিল তুমি দেখতে পেলে না। দুমাস আগে সাত হাজার টাকা দিয়ে কেনা। টাকা কি গাছে ফলে?”
মিনতি উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। সজল হাত-পা ধুয়ে, চোখে মুখে জল দিয়ে মুছতে মুছতে বলল – “তোমার আর কি? একটা মোবাইল গেছে, আবার একটা আসবে। বাড়ীর চাকর তো আছেই, সে টাকা দেবে। ডিজগাস্টিং।“
মিনতির কাছে কোন উত্তর না পেয়ে সে আরও কিছুক্ষণ গজরাতে গজরাতে চুপ করে গেল। খাবার টেবিলেও দুজনের মধ্যে ভালভাবে কথা হল না।
রাতে একটা সিরিয়াল দেখে শুতে এসে সজল দেখল মেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। মিনতি ওপাশ ফিরে কাঁদছে। সে মেয়েকে নিজের বালিশে শুইয়ে দিয়ে মিনতির পাশে এসে শুল। হাত দিয়ে মিনতিকে পাশ ফেরানোর প্রথম চেষ্টা বৃথা হতেই সে বেশ জোর দিয়েই তাকে নিজের দিকে ফেরাল।
মিনতির দুচোখ ভরা জল দেখে সে বলল – “অত কাঁদছ কেন?”
মিনতি – “সারাদিন কলুর বলদের মতো খাটি। মেয়েকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া, নিয়ে আসা, রান্না করা, কাপড় মেলা, কাপড় গোছানো, বাজার করা – সবকাজই তো করি। তোমাকে একটাও কাজ করতে দিই না। তবু তুমি বললে সারাদিন কোন কাজই করি না। মেয়েকে সারাক্ষণ দেখলে সংসার চলবে কী করে? কোনো দিন তো ও কিছু বাইরে ফেলে না। আজ হঠাৎ ফেলবে আমি বুঝব কী করে?”
সজলের রাগ কমে গিয়েছিল। মিনতির অকাট্য যুক্তি তার মন গলিয়ে দিল।
“আচ্ছা, তখন রাগের মাথায় ঐসব উল্টোপাল্টা বলে ফেলেছি। অ্যাই এম সরি।“ – বলে সে মিনতির চোখের জল মুছে দিল। তারপর মিনতির অশ্রুসিক্ত দুটি চোখে সে চুমু খেল, তারপর নাকে, সবশেষে ঠোঁটে।
চুম্বনের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে মিনতি সজলকে তার নিজের আরও কাছে টেনে নিল।
– তিন –
দুর্গামন্দিরে মহাষ্টমীর অঞ্জলি চলছে। এটা দশম ব্যাচ। পুরোহিত মশাই চিৎকার করে মন্ত্র বলে দিচ্ছেন। ভক্তদের মন্ত্রের পুনরাবৃত্তিতে মন্দির প্রাঙ্গণ গমগম করছে। এই একই ব্যাচে অঞ্জলি দিচ্ছে সুমিত ও মিনতি।
অঞ্জলি শেষ হতেই মিনতি দুর্গা ঠাকুরের কাছে পরিবারের সকলের সুখ, শান্তি, নিরাপত্তা কামনা করা ছাড়াও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করল – ‘ঠাকুর, সব বন্ধুদের কেনা দামী বিভিন্ন জিনিষের জন্য মাথা হেঁট হয়ে যায় বলে আগেরবার তোমার কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছিলাম। তোমার কৃপায় আজ নতুন মোবাইলের জন্য ওরা আমাকে সমীহ করছে। অসংখ্য ধন্যবাদ।‘ প্রণামী স্বরূপ সে আজ একান্ন টাকা দিল।
সুমিত প্রতিবার দুর্গামন্দিরে এক টাকা দিলেও আজ সে পাঁচ টাকার একটা কয়েন দিল। একমাস আগে এক জুতোর দোকানে একটা স্পোর্টস শু দেখে তার ভীষণ পছন্দ হয়। দামী বলে তার মা তাকে সেটা কিনে দিতে পারে নি। মন্দিরে এসে সে দুর্গা ঠাকুরের কাছে সেই জুতোটাই চেয়েছিল। দুর্গা মা তার অনুরোধ রেখেছে বলে আজ সে বেশি টাকা প্রণামী দিয়েছে। মন্দির থেকে বেরিয়ে পুজোয় কেনা বাটার পাওয়ারের স্পোর্টস শুটা টাইট করে বেঁধে নিয়ে সে মায়ের সাথে বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা দিল।
জুতো পড়তে গিয়ে ফোনটা বেজে উঠল মিনতির। ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে সে পুজোয় পাওয়া সজলের স্পেশাল গিফট স্যামসাং গ্যালাক্সি নোট টু বার করে ফোনটা ধরল – “মা, আমি এইমাত্র অঞ্জলি দিলাম, তোমাকে বাড়ী ফিরে ফোন করছি।“ ফোনটা অতি যত্নে ভ্যানিটি ব্যাগের মধ্যে রেখে সে তার মেয়ে পার্বতীকে নিয়ে বাড়ীর রাস্তা ধরল।
মন্দিরের বাইরে বসে থাকা পাগলা ভোলা বলে উঠল – “জয় মা দুর্গা! জয় মা পার্বতী!”
গল্পটির প্রথম প্রকাশ অনলাইন ম্যাগাজিন Hatpakha তে – http://hatpakha.com/icchapuron/
darun laglo ……..
dhonyobaad. Blog-e amar lekha baki golpogulo pore motamot jananor onurodh korchi… asakori valo lagbe!!!